• ২৭শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , ১৪ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ , ১৮ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

সামাজিক মাধ্যমের ব্যাবহার ও আমাদের লাগামহীনতা

admin
প্রকাশিত আগস্ট ২৭, ২০১৮

লন্ডনে ইস্ট থেকে ওয়েস্ট, হিত্রো এয়ারপোর্ট সাইন ফলো করে টেম্স নদীর পাশ বয়ে ড্রাইভ করলে ব্রিটিশ পাইর্লামেন্টকে হিট করার পূর্বেই একটি ট্রাফিক লাইট যেখানে প্রায়ই যাত্রা বিরতি করতে হয় মিনিট খানিক। যতক্ষণ না পর্যন্ত ইউ সি দ্যা গ্রীন সিগন্যাল অন-টু মুভ অন । এই ক্ষাণিক সময়ে আমার কানে প্রায়ই বাঁধে মেয়েদের হাসির আওয়াজ । আমার মধ্যে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা- দিনে দুপুরে পেত্নীর মত করে এখানে প্রতিদিন কে হাসে । একদিন মনোযোগ নিয়ে আমার গাড়ির ফ্রন্ট উইন্ডো খুলে দেখলাম এক নয় একাধিক সেল্ফি সুন্দরী সেলফিস্টিক হাতে নিয়ে কাঠবিড়ালির মত মুখ বানিয়ে হাঃহাঃহাঃ হিঃহিঃ করে হাসছেন আর ফটো তুলছেন। একটি নয় দুইটি নয় একের পর এক ফ্লাশ নিচ্ছেন যা হয়ত সিলেক্ট হবে পরবর্তিতে ‘দ্যা বেস্ট অফ দ্যা বেষ্ট photos of কাঠবিড়াল মুখী যা শেয়ার হবে সোশ্যাল মিডিয়ায়’। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পর্যটকদের কাছে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট একটি আইকনিক বিল্ডিং- যার ডিজাইন অত্যন্ত দৃষ্টিকটু ও নান্দনিক। প্রতিদিনই মেইন রোডে ট্রাফিক লাইটের পাশে দাঁড়িয়ে পার্লামেন্ট বিল্ডিংকে ফ্রেইমের ভিতরে যুম ইন করে শতশত পর্যটকরা ফটো তুলছেন আর শেয়ার করছেন সামাজিক মাধ্যমে। অতি excitement এর কারণে গাড়ি বা ট্রেনের নিচে পড়ে কখনো কোনো এক্সিডেন্ড হয়নি এ যাবৎ। আমাদের দেশে লোকজন একটু বেশি ইমোশোনাল। আনন্দ ফূর্তি করতে গিয়ে অতিউৎসাহী হয়ে প্রায়ই বড় বড় এক্সিডেন্ডে ঘটাচ্ছে । দেশে বিদেশে আমাদের সকলের যাত্রা নিরাপদ শুভ হোক সেটাই আমার প্রত্যাশা । সামাজিক মাধ্যম নিয়ে কথা বলতে চেয়েছিলাম। কোথা থেকে শুরু আর কোথায় শেষ করব ভেবে পাচ্ছিনা । আমি নিজেও ফেইসবুক ব্যাবহারকারী তাই অন্যকে উপদেশ দেয়ার পূর্বে নিজেকে সংশোধন সময়ের দাবি । আমার কাছে কেন জানি মনে হচ্ছে আমরা প্রায়ই কোনো সুযোগ-সুবিধা পেলে এর অপব্যবহার করি । যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের জন্য ওয়ার্ক পারমিট ভিসা, স্টুডেন্ট ভিসা সুবিধা আমাদের দেশের দক্ষ বেকারদের কর্মসংস্থান ও ছেলে মেয়েদের উচ্চ শিক্ষার দ্বার খুলে দিয়েছিলো unfortunately যা আজ ভেরি স্ট্রিকলি বন্ধ প্রায়! কারণ কি? একটি মাত্র কারণ আর তা হলো আমরা আইন-কানুনগুলো মানিনা, বুঝিনা বা বুঝার চেষ্টাও করিনা । আমাদের পছন্দের তালিকায় প্রথমই হচ্ছে ব্রেইক দ্যা rules, code of conduct যা অনেকটা আমাদের সহজাত অভ্যাসে পরিণত হয়েছে । আজকাল সামাজিক মাধ্যমে হাস্যকর পাঁচমিশালি স্ট্যাটাস ভিডিও ক্লিপ মেলা । ঐদিন দেখলাম জঙ্গলে গিয়ে একদল তরুণী বানরের মত মুখ বানিয়ে গেরিলার সাথে ফটো তুলছেন । সেলপি সেশন শেষ মেয়েটির হাত থেকে গেরিলা স্মার্ট ফোনটি নিয়ে বনের ভিতরে চলে গেলো-চলেই গেল। আমেরিকা বা অস্টেলিয়া হবে সঠিক মনে পড়ছে না , কতটুকু সত্য মিথ্যা তা হলফ করে বলতেও পারছিনা, দেখলাম একটি মেয়ে পুকুর পাড়ে গিয়ে পুকুরের সৌন্দর্য্য সেলফির মধ্যে নিয়ে আসার জন্য উন্মাদ হয়ে একেবারে পানির সন্নিকটে গিয়ে হাঃহাঃ হিঃহিঃ করে সেলফি নিচ্ছেন— তাৎক্ষণিক পানির মধ্যে আড়ি পেতে থাকা ভয়ংকর কুমির স্মার্টফোন সহ মেয়েটিকে গিলে ফেললো । মিনিটেই পুকুরের পরিষ্কার পানি অনেকটা রাইবিনা ড্রিংকসের মত রক্তাক্ত হয়ে গেলো । স্ট্যাটাস দিয়েছেন একজন একটু পরে আমি বেড রুমে যাচ্ছি ! আচ্ছা প্লিজ আমাকে একটু বলেন, বেড রুমে যাচ্ছেন কি স্ট্যাটাস দেয়ার প্ৰয়োজন ছিল? আমি টয়লেটে যাচ্ছি- স্ট্যাটাস দিয়ে সেটাও কি বর্ণনা করার প্রয়োজন ছিল? আমার গার্ল ফ্রেন্ডের সাথে আজ বেশ চমৎকার সময় কাটালাম । বাহ্ সুন্দর লিখেছেন রিয়েল boy ফ্রেন্ড। কিন্তু তাকে আদর করতে পারিনি! এইটা কি সোস্যাল মিডিয়াতে লিখার প্রয়োজন ছিল? একজন লিখেছেন এই মাত্র আমাদের ছাগল দুটি ছানা (বাচ্চা) দিয়ে আমাদেরকে ঋণী করিয়াছেন ! বাহ্ জীব জন্তুর প্রতি ওই ভাইয়ের কৃতজ্ঞতা বোধ প্রশংসনীয়। এক ভাই তার স্ট্যাটাসে লিখেছেন এই মাত্র আমার সন্তান সম্ভবা স্ত্রী ম্যাটারনিটি রুমে ঢুকেছেন, বন্ধুরা আপডেইট দিচ্ছি ! ভাবছি ,ফেইসবুকে তো এখন আবার লাইভ ফেসিলিটিও আছে। সেই দিন আর বেশি দূরে নয় যেদিন আমরা দেখব লাইভে বাচ্চা প্রসব হচ্ছে ! যেখানে স্ত্রীর আনন্দ বেদনা মিশ্রিত অনুভূতি কান্না পাশাপাশি ছোট্ট সোনামনির কান্নাও। লাইভ হলে আবার বাচ্চার ফটো আপলোড করাও লাগবেনা । কৃষ্ণচূড়া পলাশ আর শিমুলের দেশ আমার এই দেশ বাংলাদেশ যা প্রকৃতির নান্দনিক সৌন্দর্যে ভরপুর । জড়ায়ে ধরে কাঠবিড়ালের মত মুখ বানিয়ে সেলফি তুলার অনেক নান্দনিক সৌন্দর্য্য দেশ জুড়ে মেলা । এত কিছুর পরও চলন্ত ট্রেনের সৌন্দর্য্যকে সেলফির মধ্যে নিয়ে আসার আহম্মকি পরিকল্পনায় আমরা ব্যর্থ হয়ে প্রায়ই ট্রেনের বগির নিচে চলে যাচ্ছি । কেন যাচ্ছি বোধগম্য হওয়ার পূর্বেই আবার পুনরাবৃত্তি। কিন্তু কেন? লন্ডনে স্কাই স্যাটেলাইট টিভিতে কিছু চ্যানেল আছে যেখানে মেয়েরা তাদের বডি ল্যাংগুয়েজ সেক্সি এক্সপ্রেশন প্রদর্শন করে টিভি স্ক্রিনে ডিসপ্লে হট লাইন নাম্বারে কিছু অসুস্থ দর্শকদের ফোন করাতে বাধ্য করেন- এটা সিম্পলি তাদের নুইসেন্স বিজনেস যা ইংলিশ কালচারের সাথে মানানসই । এ নিয়ে আমাদের মাথা ব্যথা নেই ,থাকার কথাও নয় কারণ এটি ইংলিশদের কালচার। আজকাল দেখছি ,আমাদের দেশের কিছু ছেলে মেয়ে ফেইসবুক লাইভে এসে একি স্টাইলে সময় নষ্ট করছেন। Outcome কি আমার জানা নেই, আল্লাহ-ই জানেন। তাদের নির্লজ্য আচরণ এতটা নিন্মমানের যা আর্টিকেল লিখে বা মতামতে প্রকাশে অসম্ভব। আমরা এতটাই আধুনিক হয়ে গেছি যে আধুনিকতার পরশে আমরা ধরে রাখতে পারছিনা আমাদের নিন্মতম আত্মসম্মানবোধ। যদিও আমরা দাবি করছি আমরা এই যুগের আধুনিক, স্মার্ট, ডিজিটাল। আচ্ছা আমাকে বলেন-এত বিকৃত রুচিবোধ নিয়ে নিজেকে আধুনিক ডিজিটাল স্মার্ট দাবি করা কি ঠিক হবে? যাক, এইসব প্যাচাল কত লিখবেন । এখন আমরা সবাই ফেইসবুকের মালিক। সবাই অনলাইনে, সবার একাউন্ট আছে, লগ ইন লগ আউট। ফেইসবুকে বাণী বিবৃতি উপদেশ উপমা ডাবল স্ট্যান্ডার কথা-বার্তা দেখে মনে হয় দেশে গণতন্ত্র একটি শক্তিশালী অবস্থান দখল করে আছে । সবাই মনের ভাব প্রকাশ করতে পারছেন গণতান্ত্রিকভাবে, কথাও বলতে পারছেন । তাই বলছি আধুনিকতার পরশে আমরা একটু বেশিই উত্তেজিত। দেখেন, ফেইসবুক হচ্ছে একটি অতি জনপ্রিয় নেটওয়ার্কিং ওয়েব এপ্স । যেখানে সবাইকে ফ্রি এক্সেস দেওয়া হয়েছে । আমরা নিজেরা ক্রিয়েট করতে পারি আমাদের প্রোফাইল, আপলোড করতে পারি ফটো ভিডিও এবং ম্যাসেজ, যা আমরা শেয়ার করতে পারি আমাদের ফেমিলি ফ্রেন্ড আত্বীয় স্বজনের সাথে যারা ছড়িয়ে আছেন দেশে কিংবা বহির্বিশ্বে । আপনি যা শেয়ার করছেন তা আপনার দেশ বিদেশের বন্ধু-বান্ধব সবাই দেখছে । We should thanks full to the apps provider rather then miss use the opportunity . BBC নিউজে বছর পূর্বে ফেইসবুক নিয়ে একটি স্টাডি রিপোর্ট চোখে পড়ছিল, তারা বলছে আমরা অনেকেই সামাজিক মাধ্যমকে অনেকটা সিরিয়াস প্ল্যাটফর্ম হিসিবে দেখছি। প্ৰতিদিনই আমরা এর অপব্যাবহার করছি এর code of conduct, স্টাডি বলতেছে ফেইস বুকে স্ট্যাটাস আপ্লোড দিয়ে যারা মিনিটে ৫ বার মোবাইল চেক করেন কত লাইক কমেন্ট আসলো গননা করতে থাকেন —-তারা অনেকটা মানুসিক রোগি। আমি প্রায়ই ভাবি আমাদেরও এই রোগ হইছে কি না সেটা জানার জন্য কি ডা. দেখানোর প্রয়োজন আছে ? আপনারাই বলেন! আমরা কতটা মানসিকভাবে সুস্থ অসুস্থ বা অসভ্য হয়ে পড়েছি আমাদের সোস্যাল মিডিয়া এক্টিভিটির মাধ্যমেই প্রকাশ করছি প্রতি সেকেন্ডেই। ফেইসবুক ফ্রেন্ড ব্যারিস্টার আবুল কালাম তার স্ট্যাটাসে লিখেছেন ‘মাঝে মাঝে কিছু আবালদের কান্ড কারখানা দেখে মনে হয় জাকারবার্গ পাগলের হাতে দা তুলে দিয়েছেন,তিনি খারাপ বলেননি আমার কাছেও প্রায়ই মনে হয় যা তিনি লিখেছেন । উনার concern পরিবেশের পরিস্থিতির সাথে যথাযত মনে হয়েছে। আমাদের নির্লজ্জ স্টুপিড আচরণ কতটা নিছে নেমেছে তা আর্টিকেল লিখে ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। উপলব্ধি করতে হবে, ভাবতে হবে অনুভূতি দিয়ে। শুধু শুধু লেখাপড়া করলেই সু নাগরিক হওয়া যায় না। সু নাগরিকহতে হলে মনুষত্ববোধ থাকতে হয়, থাকতে হয় কমনসেন্স। স্থান কাল পাত্র মাথায় নিয়ে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারলে মানুষ ভাববে আপনার কমনসেন্স আছে। আপনার অনুভূতি আবেগ সম্বলিত স্ট্যাটাসে আপনি কি মনে করলেন সেটাকে মুখ্য বিষয় না ভাবিয়া যা শেয়ার করছেন তা পুরো বিশ্বের মানুষ কেমন ভাবে দেখবে সে দিকে মনোনিবেশ প্রয়োজন। আমাদের যা নেই তা নিয়ে হতাশা গ্লানির শেষ নেই। তাই আমাদের যা আছে তা দেখাশুনার দায়িত্ব কর্তব্য আমাদের। সুযোগ-সুবিধাকে যাতে আমরা মিস miss use না করি সেদিকে সু-দৃষ্টি রাখতে হবে। আমরা আধুনিক ডিজিটাল স্মার্ট হচ্ছি, কিন্তু আমাদের কমনসেন্স, সেন্স অফ হিউমার মানবতাবোধ নৈতিকতাবোধ শূণ্যের কোঠায়। কাজ করতে হবে ঐ সব জায়গাগুলোতে। তাই বলছি দয়া করে ফেইসবুকে সভ্যতার মাত্রাকে অতিক্রম করে এরকম লেখা লিখতে আমাদের সকলের আরো যত্নবান হয় উচিৎ। আজকের প্রাসঙ্গিক ফেসবুক আলোচনা শেষ করতে হবে। আমার মত আমরা সবাই বয়ান করতে পারি , প্রয়োজন বয়ানের বিষয়বস্তু আমাদের ব্যক্তি জীবনের প্রতিদিনের কর্মসূচিতে সংযোজন ও প্র্যাকটিস যা সময়ের দাবি বলে আমি মনে করি।

নজরুল ইসলাম
ওয়ার্কিং ফর ন্যাশনাল হেল্থ সার্ভিস, লন্ডন।
জীবন সদস্য ,বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন।
মেম্বার, দি ন্যাশনাল অটিষ্টিক সোস্যাইটি ইউনাটেড কিংডম।